‘এগলা কী হামাকেরে কাম?’

মুমূর্ষু অবস্থায় কাতরাচ্ছে রাস্তাটি। ছবি: মো. লিটন

ভ্যানে বসা ভদ্রমহিলা অঝোরে কাঁদছিলেন। মুরইল বাস স্ট্যান্ড থেকে ওই ভ্যানে উঠতে উঠতে জিজ্ঞেস করি, ‘কী হয়েছে আপনার? কাঁদছেন কেন?’ তিনি কোনো জবাব দেন না। বারবার শুধু চোখ মোছেন। আমি ভ্যানে বসা অপরাপর যাত্রীদের পানে চাই। ইতিমধ্যে তিনজন যাত্রী উঠে বসে আছেন। আর একজনের জন্য অপেক্ষা করছিলেন ভ্যানচালক। আমি উঠে বসাতে ভ্যানের চাকা গড়াতে শুরু করে।

ক্রন্দরত ভদ্রমহিলার পাশে বসে ছিলেন এক ভদ্রলোক। তিনি তাঁকে যথাসম্ভব শান্ত করার চেষ্টা করছেন। আমার অপরিসীম কৌতুহলের জবাবে তিনি জানালেন, ক্রন্দসী তার স্ত্রী। আদমদীঘি থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে ফিরছেন তারা। বউটা ছিল অন্তসত্ত্বা। ‘আর কস নারে বা। দুঃখের কতা আর কি কমো! তিনমাসের বাচ্চাডা মিসক্যারেজ হয়্যা গ্যালো!’ অস্ফুট স্বরে উচ্চারণ করলেন ভদ্রলোক।

অনুচ্চস্বরে উচ্চারণ করলেও কথাটা ভ্যানের সবার কানেই পশেছিল। ফলে সবাই কিছুটা হতবিহ্বল। কীভাবে সান্ত¦না দেয়া যায় সেই ভাষাই খুঁজছিলেন হয়ত সকলে। সবচেয়ে বেশি হতবিহ্বল আমি। ‘কীভাবে ঘটল এমন ঘটনা?’ একরাশ বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করি। উত্তর শোনার আগেই ভ্যানটা প্রবল ঝাঁকুনি দেয়। তাতে আমার পশ্চাতদেশের হাড়গুলো নড়েচড়ে ওঠে। দু’একটা হাড় মচকে গেলে কিনা কে জানে! যাত্রীরা একে অপরকে ধরে ধাক্কা সামলাই। ভদ্রলোক কাতর গলায় বললেন, ‘এই রাস্তাডাই সর্বনাশ করিছে। রাস্তাডাই যত সর্বনাশের মূল!’
তারপর তার কাছ থেকে জানা গেল, এই পথ ধরে রোজ নশরৎপুর ধনতলা আলিম মাদরাসায় যান তার স্ত্রী। সেখানে শিক্ষকতা করেন তিনি। গতকালও ভ্যানে করে যাচ্ছিলেন নিয়মমাফিক। কিন্তু বেহাল রাস্তার খানাখন্দে পড়ে বারবার মারাত্মক ঝাঁকুনি হচ্ছিল। একসময় তিনি পেটে ভীষণ ব্যথা পান। মাদরাসায় যাওয়া হয় না আর। ফিরে যান বাড়িতে। তারপর থেকে অবিরাম রক্তপাত। আজ আদমদীঘি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ডাক্তারের শরনাপন্ন হওয়ার পর ডাক্তার জানান, বাচ্চাটি নষ্ট হয়ে গেছে!

রাস্তাটির দূরাবস্থা সত্যিই বর্ণনার অযোগ্য। দু’তিনহাত পর পরই বড় বড় গর্ত, খানা খন্দ। বৃষ্টির জল জমে ছোট ছোট ডোবা-পুকুরে পরিণত হয়েছে সেগুলো। কোনো ধরনের যান চলাচলের উপযোগীই আর নেই রাস্তাটি। নশরৎপুর বাজার পর্যন্ত পৌঁছাতে পৌঁছাতে মনে হলো, পাঁজরের কয়েকটা হাড় খসে গেছে মনে হয়। এঅবস্থায় যেকোনো গর্ভবতী মাহলার গর্ভপাত হওয়াই স্বাভাবিক।

মুরইল থেকে নশরৎপুর বাজার পর্যন্ত প্রায় দুই কিলোমিটার দীর্ঘ এই রাস্তা। অর্ধেকটা মোটামুটি চলাচলযোগ্য হলেও বাকি অর্ধেকের অবস্থা অতিশয় করুণ। ‘ভয়াবহ’ বললেও কম বলা হয়। রোজ এই পথ ধরে কমপক্ষে দশ হাজার মানুষ চলাচল করেন। যানবাহন বলতে ওই ভ্যান রিকশা। আমি ভ্যানচালককে জিজ্ঞেস করি, ‘আপনাদের কোনো সংগঠন নাই?’
‘আছে তো রে বা।’
‘কোনো দিন চেয়ারম্যান-মেম্বারকে বলেছিলেন এই রাস্তার কথা?’
তিনি ঘাড় ঘুরিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করেন, ‘কী কমো?’

২.
চালক সংগঠনের পক্ষ থেকে কোনোদিন এই রাস্তা সংস্কারের দাবি ওঠেনি। তারা অতোটা অধিকারসচেতন নন, খানিকটা কম শিক্ষিতও বটে; কিন্তু এলাকায় কিছু শিক্ষিত তরুণ প্রজন্ম তো রয়েছে। তারাও কোনোদিন স্থানীয় সরকার-প্রশাসনের কাছে কোনো স্মরকলিপি পেশ করেননি। করেননি কোনো মানববন্ধন। এমন নীরব মেনে নেওয়ার সংস্কৃতি নাকি চলছে প্রায় ৭/৮ বছর ধরে। অর্থাৎ ৭/৮ বছর ধরে রাস্তাটির সংস্কার হয় না। তথ্যগুলো জানার পর একটা গোপন দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে যায় বুক থেকে। মনে প্রশ্ন জাগে, এই পথ ধরে কী এলাকার কোনো রাজনৈতিক নেতা, প্রশাসনের কর্মকর্তা যাতায়াত করেন না? তাদের মনে কী একটিবারের জন্যও ভাবনার উদয় হয়নি যে, রাস্তাটি সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া উচিত?

দেশ যখন নানাভাবে উন্নত হচ্ছে, প্রতিটি গ্রামকে যখন শহর বানানোর ঘোষণা এসেছে নির্বাচনী ইশতিহারে, তখন মফস্বলের জনবহুল এই রাস্তাটিকে এক বিরাট প্রহসন চিহ্ন বলে মনে হলো আমার কাছে। কোনো কোনো গ্রাম তো সত্যিই অনেক উন্নত হয়েছে, হচ্ছে। কিন্তু বগুড়া জেলার আদমদীঘি উপজেলার নশরৎপুর ইউনিয়নের এই রাস্তাটি কেন সাত-আট বছর ধরে বেহাল অবস্থায় পড়ে আছে, সেটি রহস্যই বটে। ওই মাদরাসা শিক্ষিকার মতো আরও কতো নারীর যে অকাল গর্ভপাত ঘটেছে এই রাস্তার কারণে তার হিসাব কে রাখে? প্রতিদিন যেখানে একজন ভ্যানচালক গড়ে পঞ্চাশবার যাত্রীবহন করতে পারতেন, সেখানে রাস্তার কারণে কুড়িবারের বেশি পারছেন না। কমে যাচ্ছে তার দৈনিক উপার্জন। গুগল ঘেঁটে জানলাম, বগুড়া জেলার এই উপজেলার ২৯ শতাংশ মানুষ এখনো বাস করছেন দারিদ্রসীমার নিচে। বলার অপেক্ষা রাখে না, রাস্তাটি এ অঞ্চলের মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত। সড়কপথে নিকটস্থ শহরে যেতে (বগুড়া ও নওগাঁ) নশরৎপুর ইউনিয়নের অন্তত দশটি গ্রামের মানুষকে এই একটিমাত্র রাস্তা ব্যবহার করতে হয়। রাস্তাটি ব্যবহার করেন নশরৎপুর বাজার, কড়ইবাজার, বিহিগ্রাম বাজারসহ বেশ কটি বাজারের ব্যবসায়ীরাও। কিন্তু রাস্তাটির ভগ্নদশার কারণে নির্বিঘ্নে পণ্য পরিবহণ করতে পারেন না তারা। ভ্যানের চার যাত্রীদের মধ্যে একজন জানালেন, নশরৎপুর বাজারে বেশকজন সার ব্যবসায়ী রয়েছেন। সারের ডিলারশিপ রয়েছে তাদের। তেমন একটি দোকানে কাজ করেন তিনি নিজে। ‘ভাঙা রাস্তার জন্যি বড় বড় ট্রাক ঢুকপা পারে না। ব্যবসা-বাণিজ্য দিন দিন ডাউন হচ্চে।’ বলছিলেন তিনি।

শুধু তাই নয়, প্রতিদিন কত অসুস্থ মানুষ সময়মতো হাসপাতালে পৌঁছাতে পারেন না এই রাস্তার কারণে তার খবর কে রাখে? প্রতিদিন কত ছেলেমেয়ে সময়মতো স্কুলে যেতে পারে না, পরীক্ষার হলে পৌঁছুতে পারে না, তার খবর কে জানে? এই ইউনিয়নে একটি ডিগ্রি কলেজসহ বেশ ক’টি উচ্চমাধ্যমিক স্কুল, মাধ্যমিক স্কুল, প্রাইমারি স্কুল, কিন্ডারগার্ডেন স্কুল, মাদরাসা ও এতিমখানা রয়েছে। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হাজার হাজার শিক্ষার্থী পড়ালেখা করে যাদের যাতায়াতের অন্যতম পথ এই রাস্তাটি। প্রায় দশ বছর ধরে অবর্ণনীয় এক যাতনা সয়ে রাস্তাটি ব্যবহার করছে তারা। কিন্তু দেখার কেউ নেই।

আবার একটি দীর্ঘশ্বাস গোপন করে ভ্যানের যাত্রীদের প্রশ্ন করি, ‘আচ্ছা, এলাকার মানুষ আপনারা যারা আছেন তারাও তো উদ্যোগ নিতে পারেন রাস্তাটা সংস্কার করার?’
প্রশ্ন শুনে পাশে বসা পঞ্চাশোর্ধ যাত্রীটি সব কটি দাঁত বের করে বলেন, ‘এগলা কী হামাকেরে কাম? এগলা তো সরকারের কাম। এমপির কাম। হামরা কী করমো রে বা?’
কী বলব? মাথা নিচু করে বসে থাকি।

আমাদের অর্থনীতিতে প্রকাশিত; ১১ মার্চ, ২০১৯

Leave a comment