অ্যাসাঞ্জ ও আমাদের সম্মিলিত শঠতা

পৃথিবীর এক একটি প্রান্তে এক একটি ঘটনা ঘটে আর গ্লোবাল ভিলেজে বসবাসকারী এই আমরা দুলে উঠি সেইসব ঘটনা অথবা দুর্ঘটনার অভিঘাতে। এই সময়ে সেরকম একটি অভিঘাতমূলক ঘটনা নিঃসন্দেহে জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের গ্রেপ্তার হওয়া।

অ্যাসাঞ্জ! আমাদের সময়ের সেই সন্তুপ্রতিম চরিত্র যিনি পৃথিবীবাসির সামনে তুলে ধরেছিলেন মোড়ল রাষ্ট্রগুলোর যাবতীয় অপকর্মের গোপন নথি। বিশেষত: ইরাক ও আফগানিস্তান যুদ্ধ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের পাঁচ লাখ নথি প্রকাশ করার পর মানুষ চাক্ষুস প্রত্যক্ষ করেছে এই মোড়ল রাষ্ট্রের ভণ্ডামি। তারপর থেকেই মূলত অ্যাসাঞ্জ বনে গেছেন এই সময়ের ‘হিরো’।

কিন্তু এই হিরোই প্রায় দশ বছর ধরে অন্তরীণ ছিলেন যুক্তরাজ্যের ইকুয়েডর দূতাবাসে। তাঁর বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য মিত্র দেশগুলোর অভিযোগ ছিল, তিনি গোয়েন্দা পদ্ধতি ও গোয়েন্দা প্রতিষ্ঠানের প্রধান কাঠামোগুলোর অবস্থানের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তথ্য প্রকাশের মাধ্যমে জনজীবনকে হুমকির মুখে ফেলেছেন। তাই তাকে গ্রেপ্তার করা প্রয়োজন। সেই গ্রেপ্তার এড়াতেই তিনি লন্ডনের ইকুয়েডর দুতাবাসে রাজনৈতিক আশ্রয়ে ছিলেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। লন্ডন পুলিশ শেষ পর্যন্ত ধরেই ফেলল জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জকে। নিরাশ্রয় কার্ল মার্কসকে একদা আশ্রয় দিয়েছিল যে নগর, সে নগর আজ অ্যাসাঞ্জকে বিক্রি করে দিতে যাচ্ছে আরেক আত্ম অহংকারী মাতব্বরের কাছে।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এভাবে অ্যাসাঞ্জকে কী গ্রেপ্তার করা যায়? নিশ্চয় যায় না। কারণ আমরা জানি যে, যেকোন দূতাবাস এলাকার ‘কূটনীতিক সার্বভৌমত্ব’ থাকে। সেই কূটনৈতিক সার্বভৌমত্ব লংঘন করে কাউকে গ্রেপ্তা করা যায় না। বিশেষত সেই ব্যক্তি যদি থাকেন রাজনৈতিক আশ্রয়ে। সুতরাং অ্যাসাঞ্জকে ব্রিটিশ পুলিশ যেভাবে জোরপূর্বক টেনে হিঁচড়ে গাড়িতে তুলে নিয়েছে তার পক্ষে তারা কী কোনো আইনী ব্যাখ্যা দিতে পারবে? মনে রাখা প্রয়োজন, অ্যাসাঞ্জ জোরপূর্বক ওই দূতাবাসে ছিলেন না। তাঁকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেয়া হয়েছিল।
ব্রিটেন সরকার অবশ্য মৃদুকণ্ঠে একটা ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করেছে। তাদের ভাষ্য: অ্যাসাঞ্জের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রে শুরু হওয়া আইনী প্রক্রিয়ার কারণে তাকে আটক করা হয়েছে। বস্তুত: এটাও আরেকটি বেআইনী বক্তব্য। কারণ অ্যাসাঞ্জ যুক্তরাষ্ট্রের কোন নাগরিক নন; তাঁর প্রতিষ্ঠান উইকিলিকস্ধসঢ়;ও সেখানকার কোন সংস্থা নয়। কোন দেশ চাইলেই অপর দেশের নাগরিককে এভাবে জোরপূর্বক হস্তান্তরের উদ্যোগ নিতে পারে না। এ ধরনের গায়ের জোরকে ভদ্রভাষায় বলে ‘আন্তর্জাতিক দস্যুতা’।

তা কেন এই দস্যুতার আশ্রয় নিল ব্রিটেন ও আমেরিকা তা তারা মুখে না বললেও সহজেই অনুমান করা যায়। অনুমেয় বিষয়টি হচ্ছে: যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো জোটের যুদ্ধাপরাধ ফাঁস করার কারণেই তারা অ্যাসাঞ্জকে আটক করেছে ও বাড়তি নির্যাতন করতে চাইছে। এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র যে বক্তব্য প্রচার করছে সেটিও চরম হাস্যকর। তারা বলছে, অ্যাসাঞ্জ তাদের দেশের ‘গোপন নথিপত্র’ পেয়েছিলেন এবং আরও নথিপত্র পাওয়ার জন্য তাদের কম্পিউটার হ্যাক করায় ভূমিকা রাখছিলেন। এজন্য তাকে বিচারের মুখোমুখি করা আশু কর্তব্য।

যুক্তরাষ্ট্রের মুখে এ ধরনের বক্তব্যকে স্রেফ ‘ভূতের মুখে রাম নাম’ বলে অভিহিত করা যেতে পারে। কেননা তারা নিজেরাই তো নিত্যদিন অপরের ব্যক্তিগত জগতে নজরদারি করছে এবং হ্যাকিং করে বেড়াচ্ছে। অ্যাসাঞ্জের বিরুদ্ধে এরূপ অভিযোগ উত্থাপনের আগে ট্রাম্প প্রশাসনের কী উচিত নয় অন্তত নিজ দেশের নাগরিকদের উপর গোপন নজরদারি বন্ধ করা? আমরা খুব বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করছি যে, ট্রাম্প প্রশাসন ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের সুশীল সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ অ্যাসাঞ্জের বিরুদ্ধে নেমেছেন। তাদের ক্ষোভাক্রান্ত যুক্তি অনেকটা এরকম: অ্যাসাঞ্জের উইকিলিকস; যুক্তরাষ্ট্রের বিগত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় অনেক স্পর্শকাতর গোপন নথি ফাঁস করে দিয়েছিল। কীভাবে কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান ও সন্ত্রাসের সমর্থক আন্তর্জাতিক শক্তিগুলো নির্বাচনী প্রার্থীদের অর্থ সহায়তা দেয় সেসব ওঠে এসেছিল ওইসব নথিতে। সুতরাং অ্যাসাঞ্জ যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য চরম হুমকি। তাকে গ্রেপ্তার করা খুবই ঠিক আছে।

বড়ই অদ্ভূত যুক্তি তাদের! যেসব কর্পোরেটরা অর্থ দিয়ে নির্বাচনকে প্রভাবিত করে তাদের ব্যাপারে মোটেও উদ্বিগ্ন নয় তারা–বরং উইকিলিকস কেন কর্পোরেটদের তথ্য ফাঁস করল সেটা নিয়েই ভীষণ উদ্বেগ তাদের! এরূপ স্ববিরোধী ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে দেখা যাচ্ছে অনেক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমকেও, যারা অ্যাসাঞ্জ ও উইকিলিকসের ফাঁস করা ইরাক ও আফগান যুদ্ধনথি ব্যবহার করে শত শত প্রতিবেদন ছেপে বছরের পর বছর পাঠকদের কাছে তা বিক্রি করেছে। এই সময় তাদের উচিত অ্যাসাঞ্জের গ্রেপ্তারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া, ব্রিটেন ও আমেরিকার এহেন ভূমিকার সমালোচনা করা। তা না করে তারা কিনা অ্যাসাঞ্জেরই সমালোচনা করছে! হায় স্ববিরোধিতা! হায় সম্মিলিত শঠতা!

অ্যাসাঞ্জ যা করেছেন তা জনস্বার্থেই করেছেন বলে প্রতিয়মান হয়। অ্যাসাঞ্জ বিশ্বের আপামর জনসাধারণকে জানিয়েছিলেন ভূয়া তথ্যপ্রমাণ নিয়ে ইরাক যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল, যে যুদ্ধের পরিণাম মধ্যপ্রাচ্যের ছারখার হওয়া, লক্ষ লক্ষ মানুষের উদ্বাস্তু হওয়া, আইএস রাজত্ব কায়েম হওয়া। উইকিলিকস না থাকলে মিথ্যা তথ্যের যে কাল্পনিক জগতে আমাদের বাস, তা আমরা তত্ত¡ দিয়ে এবং কিছু টুকরো টুকরো আবছায়া তথ্য জোড়া লাগিয়ে বড়জোর অনুমান করতাম, প্রমাণ করতে পারতাম না। উইকিলিকস সেই অর্থে রাষ্ট্রের গোপন অতিশয় কদর্য চেহারাটি উন্মোচন করেছে। আজ স্বীকার করতেই হবে যে এইসব তথ্য ফাঁসের মাধ্যমে তিনি বিশ্বের সামনে নতুন যুগের সাংবাদিকতার করণীয় দৃষ্টান্ত হাজির করেছিলেন।

সেই দৃষ্টান্তস্থাপনকারী সন্তু আজ ফৌজদারী মামলায় গ্রেপ্তার। জনস্বার্থে গোপন সত্য প্রকাশ করা যদি ফৌজদারী অপরাধ হয়, তাহলে বিশ্বজুড়ে সাংবাদিকতার মৃত্যু ঘটবে–তা হলফ করেই বলা যায়।

আমাদের নতুন সময়ে প্রকাশিত ; ১৪ এপ্রিল, ২০১৯

Leave a comment